সাদাত মুসাঃ
বিরই জাতের এক প্রকার লাল চাল আমরা খেতাম। কালিপুর বাজার, নয়তো শনি মঙ্গলের উত্তর বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসতাম। সের পাঁচেক হলে দিব্যি আমার ভেজা পলেস্টারের শার্টের সাপ্টে যেত, দুই পাল্লা হলেই রিক্সা নিতাম। বড় সন্তানের ভাগ্য, নাকি …? কুঁজো হয়ে থানা পেরিয়ে প্রফেসর মোনায়েম স্যারের বাসার ঠিক উল্টো দিকে পশ্চিমমুখী রাস্তা ধরতাম। কুমিল্লায় নানুয়া দীঘির দক্ষিণ পাড়ে বিশাল এক ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমার জন্ম, আমার মায়ের পৈতৃক ভিটা। আমার জন্মের কিছু দিন পর থেকেই আমরা মোনায়েম স্যারের বাসায় ভাড়া থাকতে শুরু করি। প্রয়াত মোনায়েম স্যার তখন আমার পিতার ছাত্র।
আমি খুবই অলস প্রকৃতির ছিলাম, এখনো আছি। মুরাদ ভাইদের বাসা আমার খুব প্রিয় ছিল, আমার ফুপি মঞ্চোর কাছ থেকে শুনা। হেঁটে রাস্তা পেরুনোর বিষয়ে আমার ছিল নিদারুন আপত্তি, এতটাই ভারী ছিলাম আমার ফুপি কোলে নিতে পারতেন না। তৌহিদ ভাই দেখলে রাস্তা পার করে দিতেন, কোলে। না হলে, আমি গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তা পার হতাম। রাস্তায় ভিড় বাট্টা ছিল না, অনেকেই মজা নিতো, ফ্রীতে। আব্বার কোনো ছাত্রী যদি আদর করে কোলে নিয়েছে, আর কেউ এই ভুল দ্বিতীয় বার করেনি। আজমেরী (দাপুনিয়া শেখ লেবু স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা) ফুফুর কাছে শুনে বলছি।
আমার মায়ের পর দ্বিতীয় নারীর নাম মঞ্চো, আমার ছোট ফুপি। গত ০৭ আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যে বেলায় অনেকটা বলে কয়ে জাগতিক বিদায় নিলেন। এবার আমি শুধু অলস নয়, একান্ত স্বার্থপর হলাম। ঢাকায় সেন্ট্রাল রোডে লাশের অগ্রগতি জেনেছি, কিন্তু সশরীরে কেন্দুয়ার মোজাফ্ফরপুরে যাবার সাহস হারিয়েছি। এতটা স্বার্থপর হলে সত্যি জীবনের অর্থ হারিয়ে যায়। আমি খাদক ছিলাম, মঞ্চো আমার যত্ন নিয়েছেন নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি। ভালোবেসে আমার ফুপু জিতে রইলেন, আমি হেরে গেলাম মৃত্যু ভয়ের কাছে।
ভাতের খিদে যে জীবনের নাম, তা আমি প্রথম টের পাই আলালের বন্দে। পানিতে ডুবানো হাওরের মাঝে জমি খুঁজে বের করার জন্যে আমার প্রয়াত চাচা আবু সালেক আমাকে পাঠালেন ইটনার হাওরে, আলালের বন্দে, সঙ্গী উনার জ্যৈষ্ঠ পুত্র আমার চাচাত ভাই আবু নাসের (সিনিয়র শিক্ষক, ইটনা সরকারি মহেশ চন্দ্র শিক্ষা নিকেতন)। সাত সকালে আমরা মুড়ি মুড়কি খেয়ে বের হই, কতক হেঁটে আর কতক নৌকায়। কিন্তু আলালের বন্দে সকাল দশটা বেজে গেলে আমি অস্থির হয়ে যাই, সাদা ভাতের খিদে। নাসের ভাইকে বললাম, আর পারছি না। আসলেই: সাদা ভাতই জীবন, জীবনের নিয়ন বাতি।
সাদা ভাতের কস্ট দ্বিতীয়বার টের পেলাম, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে, পশ্চিম সাহারায়। তিন দিন দুই রাত ওভার নাইট পেট্রোলে এমআরই (মিল রেডি টো ইট) খেয়ে আমার আবার মনে হয়েছিল: ডলার নয়, সাদা ভাতই জীবন।
করোনা কাল আমাকে নতুন করে ভাত চিনালো, সাদা ভাতের কষ্ট। হাতে টাকা না থাকলে ভাতের কষ্ট হয়, জানতাম। যেটা জানতাম না, কেনার সামর্থ্য থাকলেও ভাতের কষ্ট হয়। নিয়তির নিয়মে…
মার্চের শেষ দিক থেকে আমাদের কোনো গৃহকর্মী নেই। প্রথম দিকে আমি ঘর সাফ ছুতোর করতাম, আমার স্ত্রী রান্না করতেন, চারটে বেজে যেত, ক্ষুধায় কষ্ট পেতাম। আমি জানতাম, আমার স্ত্রী এই কাজটি পারবেন না। উনার শারীরিক অবস্থা এই রকম একটি কাজের জন্যে সক্ষম নয়, উনার প্রতি অন্যায় হচ্ছে। অল্প কয়েক দিনেই আমার স্ত্রী কর্মটি থেকে ইস্তফা দিলেন, একান্ত যৌক্তিক ও মানবিক। সন্তানদের এমন কর্মের জন্যে প্রস্তুত করিনি। কি নিদারুন সময়……
আমার মা লাকড়ির চুলায় রান্না করতেন, আজকাল গ্যাস ব্যবহার করেন। জ্বলন্ত লালচে আগুনে এই জুন বা জুলাই মাসে কিভাবে রেঁধে খাওয়াতেন। মঞ্চো ফুপি আমার জন্যে অনেক দিন সকালে বসে থেকেছেন, আমি ঘুম থেকে উঠলেই রুটি সেঁকে দিবেন, গরম গরম রুটি। মোজাফ্ফরপুরে তিনি আমার যে যত্ন নিতেন, আমার মা’ও সেখানে নস্যি। কিন্ত এবার…..
চুলায় অভ্যাস আমার একদম নেই, অল্প কিছু অভিজ্ঞতা যদিও দিয়েছেন আমার মা ও মঞ্চো ফুপি। সাদা ভাত রান্না করতে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি, এটি নারী বিদ্যা হিসেবে নিয়েছিলাম। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে চুলায় আসলাম, আমার নতুন কর্মক্ষেত্র। রাইস কুকারে সাদা ভাত হয়, কিন্ত তরকারি?
দিন সাতেকের মধ্যেই দেখলাম, সব পারছি। এক্সজস্ট ফ্যানে কাজ হয় না, আমার কনিষ্ঠা কন্যা স্ট্যান্ড ফ্যান লাগিয়েছে এঙ্গেল করে, আর প্লাস্টিকের একটা চেয়ার নিয়ে বসি রান্না ঘরে। সাদা ভাত খেতে খেতে আমার মনে হয়, সাদা ভাতই জীবন।
কেন বলছি এই কথা, অসহ্য গরমে ক্লান্ত হয়ে দিন কয়েক একটি হোম ডেলিভারি সার্ভিস নিয়েছিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল তিনটের সময় অথবা রাত গড়িয়ে এগারটার সময় যখন খাবার আসে, আমরা পিতা কন্যা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করি, সাদা ভাতের জন্যে।
তবু ভালো আছি, পরম ক্ষমতাধরের ইচ্ছায়। ভাত খেতে পারছি, নির্বিগ্নে, এটাই ক’জনের কপালে আছে?
কৃতজ্ঞতা ও বিনম্র শ্রদ্ধা ওই সমস্ত নারীদের প্রতি ও সেনাবাহিনীর ওই সমস্ত পুরুষদের প্রতি যাঁরা আমার জন্যে নীরবে সাদা ভাত প্রস্তুত করেছেন। আইভরি কোষ্টের এলিস, তোমাকেও মনে রাখছি পরম শ্রদ্ধায়। আমার মায়ের জন্যে কোনো বিশেষ বক্তব্য নেই, তিনি দাসত্ব নিয়েছেন স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে।
( লেখকঃঅবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্ত)