গোপন চোখের জলে (এলেমেলো সংলাপ)
পড়াশুনাটা আমার ধাতে ছিলোনা, ভাল বাচ্চা বলতে যা বোঝায়, আমি তাও ছিলাম না। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ক্লাসে পড়া না পারার জন্যে আমার এক শিক্ষক আমাকে রক্তাক্ত করেছিলেন, আমার পলেস্টারের শার্ট ভিজে ছিল রক্তে। আমার বাবা কেঁদেছেন, আমার মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন: চাইলে, আমার বাবা ওই শিক্ষককে শাসাতে পারতেন, কিন্ত তিনি তা করেন নি।
ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমার অনেক কিছুই ছিলো না, যেমন, গাইড বই, নোট বই, সমাধান বই, ছিলো না কোনো গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টার।
আমি আসলে মাইরের উপর ছিলাম। প্রধান শিক্ষক নেছারুল স্যার (হাদী স্যার) আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছেন, এক পায়ের উপর বেঞ্চে দাড়ানো আমার নৈমিত্তিক কর্ম ছিল। সত্য স্যার টেবিলের নিচে মাথা দিয়ে কান ধরিয়ে কতোবার রেখেছেন, এর সত্যি কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তাঁরা একটি অসাধারণ কাজ করেছিলেন, আমার ভিত তৈরী করে দিয়েছিলেন, সেই শক্ত ভিতের উপর আমি আজও দাঁড়িয়ে।
হাইস্কুলে এলাম, মাইর আমার পিছু ছাড়েনি। সে যেই হউক, কি আমার পিতার ছাত্র তোফাজ্জল স্যার, অল্প সময়ের মুস্তাফিজ স্যার, দুই আজিজ স্যার, পূজন স্যার…..কার নাম বাদ দিবো ? হাফিজ স্যার মারেন নি, ফজর আলী স্যারের বিষয়ে মনে আসছেনা। তবে ইংরেজীর খালেক স্যার বালিকা বিদ্যালয়ে চলে যাবার আগেই কাজটি সেরেছেন।
বাংলার মাঈনুদ্দিন স্যার হম্বিতম্বি করলেও স্নেহ করতেন বিশেষ কারণে, লেখার পারদর্শীতা দেখে। মৃনাল স্যার এক দুবার শাসিয়েছেন, কিন্তু আবার জাতেও নিয়েছেন, ইংরেজী জানার জন্যে। আর গণিতে ছিলাম ডাব্বা মার্কা, খালেক স্যার না মেরে কি করবেন?
উনাদের কেউও আমার জীবনে অমঙ্গলের আলো জ্বালিয়ে দেন নি। সবার উদ্দেশ্য ছিল সৎ ও সরল, আমার আগামীর পথ সহজ করে দেওয়া। তাঁরা তা করেছিলেন নিরলস ভাবে, ছিল অকৃত্রিম প্রয়াস।
স্নেহের কি কমতি ছিল? আমার তা কখনো মনে হয়নি; শিশু একাডেমির প্রতিযোগিতায় আমাকে কস্ট করে ঢাকা নিয়ে এসেছেন আজিজ স্যার, জাম্বুরিতে শীতের রাতে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের মাঠে স্থাপিত তাঁবুতে আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন খালেক স্যার। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিযোগিতায় আমাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ওয়ালিউল্লাহ স্যার। ঠিকমত খাবার খেতে পারছি কিনা, এ নিয়ে আমার শিক্ষকরা আমার মায়ের ভূমিকায় নেমে এসেছেন। পূজন স্যার পকেট মানি দিয়েছেন স্নেহাদ্র চিত্তে, ঠিকঠাক দিতে না পারার জন্যে জগৎ ভুলানো হাসি দিয়েছেন।
শিক্ষকদের তুলোধুনো করলাম, মূল হোতার কথাই এখনো বলিনি, প্রফেসর আবদুল হান্নান। ইংরেজী শিখিয়েছেন, এক প্রকার হেলাফেলায় আর রেখেছেন মাইরের উপর। বাসায় প্রথমে ইত্তেফাক রাখা হতো, একটি নিদৃষ্ট সময়ের মধ্যে আমাকে কখনো সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করতে দিয়ে তিনি হারিয়ে যেতেন। দুই প্রকারের মাইর হইত: টাইমের মধ্যে শেষ না হলে এবং ভুলচুকের জন্যে। এই কাজ করেছি অষ্টমে, নবমে নতুন দফা। একই কাজ, অবজার্ভার থেকে বাংলা অনুবাদ।
মাইর শুরু হলে উনার স্ত্রী’র (আমার মা) বক্তব্যটি খুবই প্রনিধানযোগ্য: ‘ দুই দিনও ঠিকঠাক পড়ায় নাই, এখন শুরু করছে নাই কামে মাইর। পোলাডারে তো আগে শিখাইবো! কে শুনে কার কথা?’ উনার স্ত্রীর মন্তব্য, তাই আমার নিজস্ব কোনো মন্তব্য নেই।
কিন্ত এই ইংরেজী বেচে আমি জীবিকা নির্বাহ করেছি, কর্ম জীবনে এই শিক্ষা আমার পথ চলাকে সম্মানজনক করেছে। মাঈনুদ্দিন স্যারের বাংলার সঞ্জীবনী সুধা বিষয়টিকে পোক্ত করেছে।
স্বল্প বিরতিতে সন্তান ধারণের জটিলতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আমার মায়ের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু তিনি আমাকে একটি অনন্য বিষয়ে রপ্ত করিয়েছেন, নাম তার ‘সহনশীলতা’।
আরেকজন শিক্ষকের কথা বলেই ইতি। কালিপুরে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, ডাঃ আবদুল ওয়াহেদ (দাদা ডাকতাম, আপন দাদার চেয়েও একটু বেশী)। আমার মাকে বিরক্ত করা শুরু করলেই বাংলা বর্ণের একটি বই দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন দাদার ডিস্পেন্সারিতে। পড়েছি অল্পই, কিন্তু ধ্বংস করেছি অনেক: চায়ের কাপ, বেলা এগারটায় উনার নাশতা আমার পেটে, আরও কতকি?
সবাই ভালোবেসে সব করেছেন, ছিলেন নির্মোহ আর নির্লোভ। পৃথিবীর তাবৎ শিক্ষকের মঙ্গল কামনা করছি।
আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।
লেখক; সাদাত মুসা (অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা)
০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০