জামালপুর, মাদারগঞ্জের জুড়াখালী বাজারের পাশেই নিশ্চিন্তপুর (Chabi Ghar Asad, Sir, by any case, is it near to your village home?) পৌঁছেতেই নিশুতি রাত, সন্ধ্যে সাতটা। মূল ঠিকানায় পৌঁছানোর পর কুপিবাতির তিবক্রা অগ্নিশিখায় বাড়ির কর্তা আমাদের দুই বন্ধুকে একটু যাচাই করে নিলেন। যে সমবয়সী কিশোরটি আমাদের ওই বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিল, তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলাম। গল্প অন্যত্র।
খিদের জ্বালায় পেট জ্বলছে, হাত মুখ ধুতে গিয়ে পানি খেয়ে নিলাম। মূল বাড়ির সামনের উঠোনে ছোট একটি টিনের একচালা ঘরে আমাদের থাকতে দিলেন, চাটাই বিছানো চৌকি পাতা ছিল। কিন্তু খাবার, রাত নয়টা নাগাদ অল্প মুড়ি পেয়েছিলাম। দশটার সময় মোটা চালের খিচুড়ি আর হাঁসের ডিম ভুনা, অমৃতসম এক ডিনার।
আমরা ভাইবোনেরা সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম, আম্মার একটা সহজ রেসিপির নাম আতপ চালের খিচুড়ি আর ডিম ভুনা, অনেক খেয়েছি, কিন্ত স্বাদের কাছে ওই রাতে যমুনা তীরের খিচুড়ি ছিল, রাফতা রাফতা ওউ মেরি….দিলকা মেহবুবা।
সারা পৃথিবীতেই চীনের জয় জয়কার, ট্রাম্পের ট্রাম্প কার্ডও ওই দেশ। খোদ রাজধানীর রেলওয়ে স্টেশনে একদিন এক দৃশ্য আমাকে নতুন ভাবে ভাবতে শিখালো। চলতি ট্রেনের সাথে দৌড়ে চলছে একদল মানুষ, আমি ভাবলাম, ট্রেনতো এই স্টেশনেই থামবে, তাহলে সমস্যা কি? সমস্যা খিচুড়ি, রাতে যাত্রীদের মেন্যুতে খিচুড়ির সাথে ডিম, সবজি বা অন্য কি জানি ছিল, সবাই সবটুকু খাইনি। ডাস্টবিনে চলে যাবার আগেই ওই টুকু খিচুড়ি তাকে পেতেই হবে, তাই এতো দৌড়ঝাঁপ।
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’ ভাওয়াইয়া সংগীতের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের এই গান হৃদয় কাড়েনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ এর প্রাক্কালে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্যে সশস্ত্র বাহিনী কে মাঠ পর্যায়ে নিয়োগ করা হয়। আমার মাঠের নাম চিলমারী বন্দর, তিস্তা পাড়ের অতি অনুন্নত একটি এলাকা। মিছিল মিটিং হয় দুয়েকটা, কিন্ত মিছিলের গায়ে হিমেল শীতের মতো লেপ্টে থাকে তিস্তা পাড়ের মানুষের খিদে, ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ তাঁরা বোঝেন না।
সবই ঠিক ছিল, সমস্যা হলো: উপজেলা শহরে মাত্র একদিন গরুর মাংস পাওয়া যায়, তাও আবার আগেভাগেই বলে রাখতে হয়, আমরা দুই দিনের জন্যে কিনলে অন্যরা আবার কিনতে পারেনা। ডাল খিচুড়ি কি ভুনা মাংস ছাড়া চলে? কিন্তু কোথায় পাবো? এখনও কি চিলমারী বন্দরে একদিনই গরু জবাই হয়?
আইভরি কোস্টের মাংসের বাজারে আমি গিয়েছি বেশ অনেকবার, মূলত ফ্রেশ মাংস পাবার জন্যে, কম দামে। কসাইদের দশাসই কলেবর আর কসাইয়ের সরঞ্জাম দেখে আমি ভয় পেতাম, তাই সাথে নিতাম কাউকে, কি আমার কোর্সমেট জোবায়ের (বর্তমানে ব্রিগ জেনারেল), অথবা ২৮ এর মঞ্জুর (বর্তমানে ব্রিগ জেনারেল)। রবিবারে এলিসের ছুটি, ঐসমস্ত সময়ে লেঃ কর্নেল রাশেদ আমিন (বর্তমানে মেজর জেনারেল) হঠাৎ হয়তো খিচুড়ি রান্না করতেন, ডাল খিচুড়ি, মাংস ভুনার সাথে আচার দিয়ে কি অপূর্ব!
সদর দপ্তরের সার্বিক নিরাপত্তা, প্রটোকল ও ইত্যাদি সেবা প্রদানের জন্যে একটি বাংলাদেশী কন্টিনজেন্ট ছিল, ব্যান হেডকোয়ার্টারস সাপোর্ট কোম্পানি, বাংলাদেশীদের মিলনকেন্দ্রও বটে। কন্টিজেন্টের একটি মসজিদ ছিল, জুম্মার নামাজ ছিল বহুজাতিক প্রার্থনার এক দৃশ্যায়ন, এক কাতারে। জুম্মার দিনে তাঁরা একটি অনন্য আতিথেয়তা দেখাতেন, দুপুরের আহার। নানা দেশি মানুষ, এক মেন্যু, ডাল খিচুড়ি, মাংস ভুনার সাথে আচার। আহা!
‘৯৫ সালের উত্তরাঞ্চলীয় আকস্মিক বন্যায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় আমরা পাঁচটি লঙ্গর খানা চালিয়েছিলাম। সার্জেন্ট পদবীর কর্মকর্তারা কোনো প্রকার বিদেশী প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্থানীয়ভাবে কুক ও তার সহকারী জোগাড় করে পুরো বিষয়টি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন, তবে বিতরণ কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবকদের সেবা নেয়া হয়েছিল। প্রতিদিন এক বেলা ডাল খিচুড়ি ছিল, সাথে ডিম ভুনা।
একদিন বিকেলে একটি লঙ্গর খানা দেখতে গিয়েছিলাম, চারটে নাগাদ। এক দেব শিশু দাঁড়িয়ে আছে থালা হাতে, মলিন দৃষ্টিতে। পাতিলের তলা ঘষে খিচুড়ি মিলেছিল বটে, ছিলোনা মাংস কিংবা ডিম।
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু,
আনমনে।…..
শূন্য়ে মহা আকাশে,
তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে,
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে,
নিরজনে প্রভূ, নিরজনে, খেলিছ।
লেখক,অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০