সাদাত মুসাঃ
রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা নেই, পাস কোর্সের তিনশো মার্কের ওই তিনখানা পেপার ছাড়া। তাও আবার আটকে গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’তে এমবিএ (দিবাকালীন) এর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে। শ্রদ্বেয় নাজমা ম্যাডাম আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অর্জিত মার্ক্স্ দেখে আমার জানার দৌড় জানতে চাইলেন, বিশদে। আমি শুধু বলেছিলাম: তিন পত্রে পরীক্ষা ছিল, প্রথম পত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব, দ্বিতীয় পত্রে তুলনামূলক সংবিধান এবং তৃতীয় পত্রে আঞ্চলিক ও বাংলাদেশ রাজনীতি। আর কিছু? আমি উত্তরে অপারগতা প্রকাশ করেছি।
আজকের প্রধানমন্ত্রী ৯৬ পর্বে প্রথম দায়িত্ত্ব নেবার পর খুব বেশি কথা বলতেন, এই বেশি বলার জন্যে উচ্চ আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিলেন। সত্যের উপর ধূলো চাপা দিয়ে একুশ বছরে জমে উপরে উঠা গোয়েবলস এর মিথ্যের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তিনি হয়তো একটু বেশিই বলতেন। আমার কাছে মনে হতো, আমরাতো বলছি, উনাকেও বলতে হবে কেন?
ইদানিং তিনি কম কথাই বলেন, তবু পুরোনো অভ্যেস বলে কথা! গতকাল (২৬ আগস্ট, ২০২০) ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি একটি অনন্য কথা বলেছেন: ছয় দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর একান্ত চিন্তার ফসল।
৭৫ পরবর্তী সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক ভূলে (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে) নাম লিখিয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেছে: যিনি গোটা দেশের সম্পদ, এমনকি বিশ্বগর্ব তাঁকে স্বল্প পরিসরে নিয়ে আসার দায় শুধুমাত্র দলটিকেই দিতে চাই। এর ব্যাখ্যা আমার অজানা নয়, কিন্ত এটি নিয়ে লিখতে চাচ্ছি না।
বিশ্বসংসার চলছে এখন কূট চালে, সর্বত্রই এখন কূটচাল: শিক্ষা, সংসার, অর্থ, এমনকি ধর্ম, কোথায় নেই এই কূটচাল? মজার ব্যাপার হলো, এই কূটচালের মধ্যমার নাম আজকের রাজনীতি। স্বল্প বিদ্যা নিয়েই বলবো: রাজনীতি বিজ্ঞানের নতুন নাম কূট বিজ্ঞান।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি অনলাইন ভার্সনে আসার সাথে সাথে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (খুব সম্ভবত রাষ্ট্রকে ভয় পায়) মন্তব্যকারীদের ইচ্ছাকৃত মন্তব্য পড়েছি সারাদিন, অতি নেতিবাচক মন্তব্য সন্ধ্যের আগেই সরিয়ে নিয়েছে কয়েকটি পত্রিকা।
কারণ কি? আওয়ামী বিদ্বেষ, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার, নাকি ইতিহাস বিকৃতি, এমনকি পাকিস্তানপ্রীতি? সহজ কারণও থাকতে পারে, ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞানের অভাব। যাই হউক…..
প্রধানমন্ত্রী কি অসত্য বলেছেন? ইতিহাস কি বলে? আওয়ামী লীগের মধ্যেই ছয় দফা নিয়ে মতভেদ ছিল। দলের অনেক নেতারই ছয় দফায় সমর্থন ছিল না। আওয়ামী লীগের পরামর্শদাতা ও দলের মুখপত্র ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
‘৬-দফার কোন কোন দফা আমি সমর্থন করি না সত্য, কিন্তু ৬-দফা ভাল কি মন্দ, সেই প্রশ্ন মুলতবী রাখিয়াও আমি বলিতে চাই যে, এই কর্মসূচী সাধারণ্যে প্রকাশ করিবার পূর্বে আমার সাথে কেহ কোন পরামর্শ করে নাই। [পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর, ঢাকা, ২০০৭]
আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে, রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস হচ্ছে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন ব্যতিরেকেই ৬ দফা উপস্থাপন করেন, তাঁর ব্যক্তিগত সুপারিশ হিসেবে। কয়েক সপ্তাহ পরেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ছয় দফাকে অনুমোদন করিয়ে নেন।
ছয় দফা’র ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই ব্যাখ্যাসংবলিত পুস্তিকাটি বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখেছিলেন, কাউকে ডিকটেশন দিয়ে লেখাননি। [সূত্র: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববার্তা, ০৭ জুন, ২০২০ ]
ছয় দফা ইতিহাসে বা রাজনীতির পথচলায় কতটা গুরুত্ত্বপূর্ন, তা নিয়ে আমি বলতে চাচ্ছি না। একজন পরিণীত রাজীনীতিবিদের এক অনবদ্য স্বাক্ষী শেখ মুজিব। পথচলায় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন নিবেদিত প্রাণ ও প্রজ্ঞাবান রাজীনীতিবিদ তাজউদ্দীন এবং বেশ আরও কয়েকজন। আজকের শেখ হাসিনা তেমনটি পান নি, একজন নিঃসঙ্গ শেরপা, আগামীর ইতিহাস স্বাক্ষী দিবে।
বৃক্ষটি যদি বাংলাদেশ হয়, বীজ সংগ্রহ হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে, জেগে উঠা বৃক্ষকাণ্ডের নাম ছয় দফা, কাণ্ডের কাষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ, আর যা কিছু আছে (৭ মার্চ, ২৫/২৬/২৭ মার্চের ঘোষণা) সবই ডালপালা, বাকল, ফুল এবং পাতা। ফলটির নাম স্বাধীনতা, সবকিছুর সাথে সাপ্টে আছেন বঙ্গবন্ধু। মূল আর মুকুটে মিশে আছে আমাদের নিপীড়িত জনতা।
সবাইকে শুভেচ্ছা। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছি।
২৭ আগস্ট, ২০২০
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্ত)