অনলাইন ডেস্কঃ করোনা মহামারির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার আশঙ্কা ছিল রাজধানীর ২০টি বস্তি। জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব ছাড়াও একই রান্নাঘর, টয়লেট, পানির উৎস অনেকে মিলে ব্যবহার, ঠাসাঠাসি করে এক ঘরে পরিবারের সবাই থাকা, খোলা নর্দমা, অস্তিত্বহীন বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বস্তিবাসীদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাদেরকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের চার মাসেরও বেশি সময় পরেও কোনো বস্তি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে, এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
দ্য ডেইলি স্টার সম্প্রতি কড়াইল, চলন্তিকা, ভাষানটেক, বাউনিয়াবাঁধ, আবুলের বস্তি ও লালাসরাইয়ের বস্তি সরেজমিনে ঘুরে এসেছে। এসব বস্তির বাসিন্দাদের একই কথা, এখানে করোনা আক্রান্ত কেউ নেই।
‘এই বস্তিতে কোনো করোনা রোগী নাই। এটা ধনীদের রোগ’— এই কথাটি শুনতে হয়েছে প্রায় প্রতিটি বস্তি থেকে। বস্তির এত বেশি মানুষ এই কথা বলেছে, মনে হয়েছে এটাই বুঝি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে প্রমাণিত এবং সর্বজনবিদিত সত্য।
কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির বউবাজার ইউনিটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুস সোবহান বলেন, ‘আপনি কেন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলছেন? মানুষ এখন আর আগের মতো অসুস্থ হচ্ছে না।’
বস্তিতে বসবাসরত ৪০ বছর বয়সী গৃহকর্মী কামরুন্নাহার মাস্ক ব্যবহার করেন না। তার মতে, ‘কোনো করোনাভাইরাস নাই।’
করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারানো এই নারী বলেন, ‘রাতে কী খাবো, সেটা নিয়ে আগে ভাবি। মাস্কের কথা পরে ভাবা যাবে।’
১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমান বস্তিবাসীদের কথাই প্রতিধ্বনিত করে বলেন, ‘এখানে সংক্রমণের হার খুবই কম।’
গত ২১ জুলাই দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরাজাদি সেব্রিনা ফ্লোরাও বস্তিবাসীদের কথাই প্রতিধ্বনিত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা রাজধানীর বস্তিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। সেখানে সংক্রমণের হার বেশি দেখছি না।’
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী রয়েছেন। অথচ, চলন্তিকা, ভাষানটেক ও বাউনিয়াবাঁধ বস্তিও এই মিরপুরেই অবস্থিত। তারপরও বস্তিবাসীদের মধ্যে এই সংক্রমিত রোগ ছড়িয়ে না পড়া বেশ অবাক করার মতোই।
একইভাবে, কড়াইল বস্তি অবস্থিত মহাখালীতে। মহাখালীও করোনার উচ্চ সংক্রমণের স্থান।
তবে, সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর বিষয় হলো কয়েক দশক ধরে পাওয়া বৈজ্ঞানিক প্রমাণ অনুযায়ী বস্তিবাসীরা যেকোনো রোগে অসুস্থ হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
ঢাকার একটি ইংরেজি সংবাদপত্র বস্তিবাসীদের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তার ভিত্তিতে উঠছে একটি প্রশ্ন। তা হলো— বস্তিবাসীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ হচ্ছে না? নাকি পরীক্ষার অভাবে তা শনাক্ত হচ্ছে না?
করোনা সংক্রমণের পর লকডাউন শুরু হওয়ার পরপরই বাবু তার পুরো পরিবারসহ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু, পরীক্ষা করাতে পারেননি। কড়াইল বস্তিতে মোবাইল ফোন রিচার্জ ব্যবসায়ী বাবু সর্বপ্রথম তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার তিন বছর এবং আট বছরের ছেলেরাও ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রত্যেকেই ২০ দিন থেকে দেড় মাস অসুস্থ ছিল।
কেন কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাননি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কেন করব? বস্তিতে কোনো করোনাভাইরাস নেই। তা ছাড়া, কোথায় পরীক্ষা করতে হবে তাও আমি জানি না। করোনা হলে চিকিৎসার জন্য আমার কাছে টাকাও নেই। তাহলে আর ওসব নিয়ে চিন্তা করে কি হবে?’
ভাষানটেকের এক ওষুধের দোকানের স্বত্বাধিকারী কৃষ্ণ দে জানান, তিনি প্রচুর পরিমাণে ফ্লুর ওষুধ বিক্রি করছেন। তবে, সেখানকার বাসিন্দাদের কেউই কখনও করোনা পরীক্ষার করানোর জন্য চেষ্টাও করেননি।
তিনি বলেন, ‘এই বস্তিতে আমাদের কারো করোনার সংক্রমণ আছে কি না, আমরা জানি না।’
চলন্তিকা ও অন্যান্য বস্তির বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানের মালিক ও কর্মচারীরাও একই কথাই জানিয়েছেন।
চলন্তিকা বস্তির বায়তুল নূর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন জানান, তিন সপ্তাহ আগে বস্তিতে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ মারা যান। তার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘সবাই বলছিল যে তিনি বৃদ্ধ বয়সে মারা গেছেন। তার করোনা পরীক্ষার দরকার নেই।’
ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী শিপ্রা রানী মৃধা জানান, বস্তিবাসীদের মধ্যে থাকা ভুল তথ্য ও কুসংস্কারই আসল চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়েছে তার কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমি জ্বরে আক্রান্ত কয়েকজনের নাম সংগ্রহ করেছিলাম যাতে তাদের পরীক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করতে পারি। নাম নিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই তাদের পরিবারের সদস্যরা আমার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের অনুরোধ, আমি যেন জ্বরে আক্রান্তদের কথা কাউকে না জানাই। তাদের ভেতরে ভয় ছিল যে তাদেরকে বহিরাগত বলে মনে করা হচ্ছে বা পুলিশ তাদের “গ্রেপ্তার” করে নিয়ে যাবে। কেউ কেউ বলেছিল যে তারা শুনেছেন কোয়ারেন্টিনে নিয়ে রোগীদের মেরে ফেলা হয়।’