হঠাৎ গুলিতে এলোমেলো মশিয়ালী গ্রাম

admin / ৬৭ দেখা হয়েছে
প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০২০

খুলনার ফুলতলা উপজেলার খানজাহান আলী থানাধীন মশিয়ালী গ্রাম। এই গ্রামেই বৃহস্পতিবার রাতে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় তাণ্ডব। এলাকার প্রভাবশালী শেখ জাকারিয়া ভাইদের ছোড়া বৃষ্টির মতো গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তিন গ্রামবাসী। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও সাতজন। এই ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শেখ জাকারিয়া ভাইদের তিনটি আলিশান দোতলা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের পিটুনিতে মারা গেছেন জাকারিয়া ভাইদের এক চাচাতো ভাই। সঙ্গে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করেছেন জাকারিয়াদের সব আত্মীয়ের বাড়ি।

মশিয়ালী গ্রামে আজ শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রাম থমথমে। মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। নিহতদের বাড়িতে চলছে মাতম।

খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলতলা বাইপাসের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যাওয়া সড়ক দিয়েই মশিয়ালী গ্রামে যেতে হয়। সড়কের মুখেই বেশ বড় আকারের একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা—‘মশিয়ালী দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, মশিয়ালী শিশু সদন এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা এবং মশিয়ালী পূর্বপাড়া ঈদগাহ ও জামে মসজিদ’। সবার নিচে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা ‘সৌজন্যে: শেখ জাকারিয়া, সভাপতি, মশিয়ালী মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ’।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দেখা যায়, সড়কে প্রবেশমুখের আশপাশে রয়েছে কয়েকটি পুলিশের গাড়ি। সেখান থেকে ঘটনাস্থল প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটাপথ। বিভিন্ন গাছতলা ও দোকানে বসে আছেন পুলিশ সদস্যরা। এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ থাকায় তাঁরা ভেতরে যাচ্ছিলেন না।

সড়ক ধরে মোটরসাইকেলে মিনিট পাঁচেক এগোতেই চোখে পড়ে, তিন দিকে চলে গেছে তিনটি সড়ক। ওই সড়কের এক পাশে ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ি। তখনো বাড়ি থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। আলিশান ওই বাড়ির দালানের বিভিন্ন অংশ খুলে নিয়ে যাচ্ছেন এলাকাবাসী। নিচতলায় গ্যারেজে আগুনে পুড়ে গেছে একটি গাড়ি। সেখানে থাকা উৎসুক মানুষগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। জানতে চাইলে সেখানে থাকা ব্যক্তিরা জানান, ‘এটি শেখ জাকারিয়ার বাড়ি। গ্রামবাসীর ওপর হামলার পর সব পুড়িয়ে দিয়েছেন এলাকাবাসী।’

মোটরসাইকেল নিয়ে কিছুটা এগোতেই ডান পাশে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে মাদ্রাসা, মসজিদ ও ঈদগাহ। আরেকটু সামনে যেতেই দেখা যায়, ভাঙচুর ও আগুনে ক্ষতবিক্ষত আরেকটি দোতলা বাড়ি। আশপাশে রয়েছে কয়েকটি দোকান। ওই বাড়ির আশপাশেও স্থানীয় মানুষের ভিড়। জানতে চাইলে স্থানীয়রা বলেন, ‘এটি জাকারিয়ার মেজ ভাই শেখ মিল্টনের বাড়ি।’ আশপাশের আরও কয়েকটি বাড়ি থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। পাশেই ছিল মিল্টনের শ্বশুরের একতলা বাড়ি। সেটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকটু এগোলেই দেখা মেলে জাফরিনের বাড়ি।

জাকারিয়া, মিল্টন ও জাফরিনের বাবা মৃত শেখ হাসান আলী খুলনা সরকারি বিএল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। এলাকায় তিনি সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ বলে গণ্য ছিলেন। তবে এ ঘটনার পর এলাকায় জাকারিয়া ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের যত বাড়ি ছিল, সবই পুড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।

এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওই এলাকায় তিনটি দোতলা আলিশান বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়ি তিনটি জাকারিয়া, মিল্টন ও জাফরিনের। তবে জাফরিনের বাড়িটির আভিজাত্যের ছটা কিছুটা বেশি।

এলাকাবাসী জানান, গ্রামবাসীর ওপর হামলার পর কৌশলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান বাড়ির সদস্যরা। এরপর তাতে আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। রাত আনুমানিক ১টার দিকে জাকারিয়াদের এক চাচাতো ভাই পালিয়ে যাচ্ছেন খবর পেয়ে এলাকাবাসী তাঁকে ধাওয়া করেন এবং পিটুনি দেন। এতে জিহাদ শেখ (২৫) নামের ওই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গতকাল সন্ধ্যায় ওই এলাকায় থাকা জাকারিয়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে মুজিবর রহমান শেখ নামের একজনকে অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশ। এলাকাবাসীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধের জের ধরে ‘নিরীহ’ মুজিবর রহমানকে ডেকে নিয়ে অস্ত্র দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন জাকারিয়া ভাইয়েরা। এ কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পরে রাত আটটার দিকে এলাকাবাসী দল বেঁধে জাকারিয়াদের বাড়ি গেলে নির্বিচার গুলি ছোড়েন জাকারিয়া ও তাঁর ভাইয়েরা। পুলিশও বলছে, জাকারিয়া ভাইদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন এলাকাবাসী। বছর কয়েক আগে বাবা হাসান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করায় বাবাকেও কুপিয়ে জখম করেছিলেন ছেলেরা।

শেখ জাকারিয়া খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহ–প্রচার সম্পাদক। হামলার পর তাঁকে ওই পদ থেকে বহিষ্কার করেছে থানা আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ছোট ভাই জাফরিন খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এলাকাবাসী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ আগে থেকেই ওই এলাকায় সুদের ব্যবসা করতেন জাকারিয়া, মিল্টন ও জাফরিন। টাকা দেওয়ার সময় সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হতো। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কেড়ে নেওয়া হতো দোকান, ঘরবাড়ি। রোজার সময় ওই এলাকায় বাবুল শেখ নামের একজন একটি দোকান দেন। ওই দোকানের জন্য তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করেন জাকারিয়া। চাঁদার টাকা না দেওয়ায় লোকজন নিয়ে দোকান ভাঙচুর ও মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই ফুঁসে ছিলেন এলাকাবাসী।

ওই এলাকার মসজিদ ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন শেখ জাকারিয়া। গত ৩০ জুন ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বাবুলের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করার অভিযোগে এলাকাবাসী এবার ওই কমিটি থেকে জাকারিয়াকে বাদ দিতে চাইছিলেন। আজ শুক্রবার পুরোনো কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করার কথা ছিল। এটা নিয়েও এলাকাবাসীর সঙ্গে জাকারিয়া ভাইদের বিরোধ চরম মাত্রায় পৌঁছায়। ওই বিরোধ থেকেই মুজিবর রহমানকে ডেকে নিয়ে হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। রাত সাড়ে আটটার দিকে এরই প্রতিবাদ করতে গিয়ে জাকারিয়া ভাইদের হামলার শিকার হন তাঁরা।

নিহতদের পরিবারে মাতম
গতকালের ঘটনায় নিহতদের একজন গোলাম রসুল। তাঁর তিন ছেলে-মেয়ে। সবার ছোট মেয়েটির বয়স ১৬ মাস। আর বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তিনি দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে তিনিও যাচ্ছিলেন ওই এলাকার প্রভাবশালী শেখ জাকারিয়াদের বাড়িতে। ওই দলে ছিলেন শত শত মানুষ। গেটের ঠিক আগেই হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। এ সময় মুহুর্মুহু গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান এলাকাবাসী। তাঁর কিছুটা পাশেই পড়ে ছিল নজরুল ইসলামের লাশ।

আজ বেলা ১১টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভেজা মাটির বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ তখনো রয়েছে। দাগের পাশেই রয়েছে একটি বন্দুকের গুলির খোসা। দেয়ালের ওপাশেই আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। দেয়ালের সঙ্গে থাকা গেটের ওপর লেখা ‘অধ্যাপক হাসান আলী শেখ’। মৃত শেখ হাসান আলী শেখের ছোট ছেলে শেখ জাফরিন থাকেন ওই বাড়িতে। ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে নির্বিচার গ্রামবাসীর ওপর গুলি ছোড়েন বড় ভাই শেখ জাকারিয়া, মেজ ভাই শেখ মিল্টন ও ছোট ভাই শেখ জাফরিন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান গোলাম রসুল (৩০) ও নজরুল ইসলাম (৫৫)। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আরও আটজন। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাইফুল ইসলামের (২৭) মৃত্যু হয়।

সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা চোখজুড়ানো ওই বাড়ির সর্বত্রই রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। মূল ফটক দিয়ে কিছুটা হাঁটতেই আরেকটি ফটক। ওই ফটকের ওপর ছিল বড় দুটি পাখির ভাস্কর্য। তবে এলাকাবাসী সবই ভেঙে ফেলেছেন। তখনো আগুনের ধোঁয়া উড়ছিল ঘরের মধ্য থেকে।

ওই বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে ইটের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই নিহত নজরুল ইসলামের বাড়ি। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত আলীম জুট মিলের শ্রমিক। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের মধ্যে মাতম চলছে। এর কিছুটা পরই গোলাম রসুলের বাড়ি। সেখানেও চলছে মাতম। রসুলের বড় ভাই ইকবাল হোসেনের পায়ে তখনো ছোট ভাইয়ের রক্তের দাগ লেগে আছে। অনেকটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

রসুলের মা জাহানারা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ভিক্ষা করে দুই সন্তানকে বড় করেছি। এখন একটি সন্তান চলে গেল। ওর ছেলে-মেয়ে এখন কীভাবে বাঁচবে?’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির অন্যান্য খবর