স্মরন;পাতা সম্পাদক ফরহাদুজ্জামান এমরান

Iqbal Hossain Jewel / ২০৪ দেখা হয়েছে
প্রকাশের সময় : বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১

আনোয়ার হোসেন শাহীন

ফরহাদুজ্জামান এমরান আর নেই। শুনেই মনটা বিষাদে ভরে গেল। মৃত্যুর খবরটা আমাকে জানান, ছড়াকার আজম জহিরুল ইসলাম। ৩ এপ্রিল (শনিবার) সকাল বেলা তিনি ময়মনসিংহ থেকে গৌরীপুরে নিজ বাসায় ‘হোসেন ভিলায়’ আসেন এবং বিকাল বেলাই পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
গৌরীপুর থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা “পাতা”-এর সম্পাদক ও নূরুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক একেএম ফরহাদুজ্জামান এমরান। তিনি ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। এক সময় সবাইকে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজ কত স্মৃতি মনে হচ্ছে । কিভাবে ‘পাতা’ প্রকাশিত হতো, এসব নানা বিষয় নিয়ে পাতার সম্পাদক ফরহাদুজ্জামান এমরান (এমরান কাকা) আমাদের মতামত নিতেন। কখনো তার উত্তর বাজারস্থ হোসেন ভিলায়, আবার কখনো বাসার সামনে প্রয়াত চিত্রশিল্পী হামিদ কাকার রেস্টুরেন্টে কথা হতো। আর পাতা প্রকাশসহ নানা বিষয়ে আড্ডা হতো বিকেল-সন্ধ্যায়।
এক সময় ময়মনসিংহের সাহিত্য অঙ্গণে ‘পাতা’ একটি পরিচিত নাম ছিলো। স্বাধীনতাত্তোর পাতা’ই ছিলো একমাত্র নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা। পাতা’কে সতেজ ও পরিচর্যা করতে এগিয়ে আসেন ময়মনসিংহের ‘অবসর সাহিত্য গোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন। অনেকদিন পাতা প্রকাশনা বন্ধ থাকায় ডিক্লারেশন বাতিল হয়ে যায়। ফরহাদুজ্জামান এমরান গৌরীপুর নূরুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর তিনি ১৯৯২ সালে আবারো উদ্যোগ নেন পাতা প্রকাশের। পাতা’কে আবারো সতেজ করার জন্য অফিসিয়াল কাজকর্ম এগিয়ে চলতে থাকে। এদিকে আমরা যারা পাতা প্রকাশের দায়িত্বে আছি এর মধ্যে সম্পাদক একেএম ফরহাদুজ্জামান, সাহিত্য সম্পাদক কামরুল আহসান দিবাকর ও আওলাদ হোসেন জসীম, ঢাকা প্রতিনিধি নতুন বাংলায় কর্মরত আজম জহিরুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক আমি আনোয়ার হোসেন শাহীন, ক্রীড়া বিভাগে মহেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক, সার্কুলেশন নূরুল ইসলাম ও প্রয়াত চিত্রশিল্পী আতাউর রহমান। আমরা এই ক’জনকে নিয়ে পাতা পরিবার। সম্পাদক ফরহাদ কাকা আমাকে বলেন, তুমিতো আঁকতে জানো, প্রচ্ছদ আঁকো দেখি কেমন হয়। আমি বলি, একজন প্রচ্ছদ শিল্পী দিয়ে প্রচ্ছদ তৈরি করুন, ভালো হবে। তিনি আবারো বলেন, চেষ্টা করো। তারপর আমি প্রচ্ছদের জন্য কতো যে গাছের পাতা ছিঁড়ে কাগজে এঁকেছি। তারপর দু’একটি নমুনা এঁকে দিই। একটু আলপনা, লগোতে পাতা লেখার ভেতরে পাতা এঁকে দিয়ে এর জমিন সাদা, লাল, হলুদ, সবুজ রং মিশ্রনে আমার আঁকা প্রচ্ছদটি তিনি ব্লক তৈরি করেন। ১ম বর্ষ সূচনা সংখ্যা আমার আঁকা প্রচ্ছদ দিয়ে সেপ্টেম্বর-৯২ইং সালে পাতা প্রকাশ করেন। সম্পাদকীয়টি ছিলো এ রকম “স্বাধীনতাত্তোর বৃহত্তর ময়মনসিংহে পাতাই ছিল একমাত্র মাসিক। বিভিন্ন প্রতিকূলতাহেতু তৎকালে পাতা বেরিয়েছে অনিয়মিতভাবে। আবারো প্রশাসনিক জটিলতার কারণে প্রকাশনা বন্ধও রয়েছে। সবকিছু অতিক্রম করে সরকারি অনুমোদন নিয়ে আজ আবারো পাতা পাঠক সমাজের সামনে হাজির হয়েছে নিজস্ব-স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট নিয়ে। এখন থেকে নতুন আঙ্গিকে পাতা বেরোবে প্রতি মাসেই। প্রবীণ ও নবীন লেখক/লেখিকা সবার জন্যই পাতা। কেননা, লেখার গুণগত মানই বিচার্য, লেখকের খ্যতি নয়। বলতে গেলে বর্তমানে দেশের পত্রপত্রিকা আজ দুটি স্রোতধারায় বহমান। এই দু’ধারার একদিকে রয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শকে ভিত্তি করে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষমূলক কাদা ছোড়াছুড়ি, আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে চটকদার রাজনৈতিক স্লোগান-সংযোজিত প্রচ্ছদ ম্যাগাজিন, অপর ধারায় সাহিত্য বিনোদন ও চিকিৎসার নামে অনৈতিকতা, অবৈধ যৌনাচার, অপরিচ্ছন্ন প্রেম বিষয়ক ঘটনাপ্রবাহ ও বিকৃত রুচির উগ্রনগ্নতা, নারীদেহের বিশেষ ভঙ্গিমা অশ্লীল বহু রংয়ের চকচকে প্রচ্ছদ সর্বস্ব পত্রিকা ম্যাগাজিন। এই দু’ধারার মধ্যদিয়ে পাতা এগিয়ে যাবে, তা সে পথ যতো বন্ধুর হোক না কেনো? পত্রিকাটি সপ্তম বছর পদার্পণের পর ১৯৯৮ সালে কামরুল আহসান দিবাকর ‘মাটি মানুষের কথা’ এই শিরোনামে একটি স্লোগান দিয়ে ‘পাতা’ স্থানীয় খবরাখবর নিয়ে ১২ পৃষ্ঠা ট্যাবলেট সাইজে পত্রিকা প্রকাশ করি। বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ৭ বছর মিডিয়ার কল্যাণে একটি সময়কে ফ্রেমে বেঁধে ফেলা, যদিও বা সে সময় প্রযুক্তি অতোটা অগ্রসরমান ছিল না। আমরা পাতার কাজটুকু লেটার প্রেসে করেছি।
ভাবতে অবাক লাগে, একটি মফস্বল শহর থেকে একটা নিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশ করা। নিঃসন্দেহে এটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাতাকে আমরা সতেজ রাখতে পারিনি। নানা কারণে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। সম্পাদক এমরান কাকা অসুস্থ হলে কাকী বলেন, তোমার কাকাকে দেখে যাও। পরে কামরুল আহসান দিবাকরকে নিয়ে কাকাকে দেখতে যাই ময়মনসিংহের ২৪ বাঘমারাস্থ এলিট হাউজে। বিকেল থেকে সন্ধা রাত পর্যন্ত সময় কাটিয়েছি। বেশ ভালো লাগলো সময়টা। পাতা প্রসঙ্গে অনেক স্মৃতিচারণ করলেন। গৌরীপুরের অনেকের কথা স্মরণ করলেন। তিনি বলেন, গৌরীপুরের ট্রেনগুলো আসলে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি। একমাত্র মেয়ে ফারিয়া জামান ওমির জন্যে এখানে থাকতে হয়। পাতায় যারা লিখতেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তসলিমা নাসরিন, শামসুল ফয়েজ, গাউসুর রহমান, আলী আহম্মদ খান আইয়্যুব, সেলিম মাহমুদ প্রমুখ। তসলিমা নাসরিন পাতা কার্যালয়ে এসেছিলেন ৯৪ সালের ১৪ জানুয়ারি সকালে। সম্পাদক মহোদয় আমার বাসার গেটে এসে ডাক দেন। শাহীন তাড়াতাড়ি এসো। নাসরিন এসে গেছে। প্রয়াত নোমান ভাই পরিচয় করিয়ে দেন, আমার বোন নাসরিন। নাসরিন আমাকে বলেন, ভালো আছেন? আলোচনা হয় হৃদ্যতাপূর্ণ। তিনি বলেন, আমি লিখছি, আমার লেখায় সত্য প্রকাশ করছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত প্রকাশের অধিকার সংবিধানিক স্বীকৃত। তা পাঠকের গ্রহণ-বর্জনের দায়িত্ব। আমাদের পাতা পরিবারের সাথে ক্ষণিক সময় কথা বলে চলে যান। এ সময় তার প্রকাশিত ‘চারকন্যা’ উপন্যাসটি পাতা পরিবারকে শুভেচ্ছা স্বরূপ উপহার দেন।
একেএম ফরহাদুজ্জামান এমরান ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার গাভীশিমূল গ্রামে ১ আগস্ট ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান সিলেটে হজরত শাহজালাল মাজার সংলগ্ন। বাবা ফুড ইন্সপেক্টর মরহুম গোলাম হোসেন, মা মরহুমা জাহানারা বেগম। প্রাথমিক শিক্ষা ময়মনসিংহের ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুল, মাধ্যমিক জিলা স্কুল ১৯৬৮ ইং। ডিগ্রি আনন্দ মোহন কলেজ ১৯৭৩ইং। বাসা ৫০ কাচিঝুলি ময়মনসিংহ। ১৯৮২ সালে বাঘমারা পাঠানবাড়ি রাশিদা খানমের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একমাত্র মেয়ে ফারিয়া জামান ওমি ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ১৯৮২ সালে গৌরীপুর নূরুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। একটা সময় যখন গৌরীপুর কোনো পত্রিকা ছিল না তখন তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি পত্রিকা প্রকাশের দুরুহ কাজটি সাতটি বছর চালিয়ে গেছেন। ৭ বছর পাতা প্রকাশ করতে নিবিড়ভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু জেনেছি শিখেছি। সততা, নিষ্ঠাবান সাদা মনের একজন মানুষকে হারালাম। আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেছেন চিরতরে। তার ঋণ শোধ করার মতো নয়। উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমরা গভীরভাবে শোকাহত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির অন্যান্য খবর